স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল ,যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা অধ্যায় এর অন্তর্ভুক্ত।

স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুরো পাকিস্তানের সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগ।

কিন্তু বেঁকে বসলেন তৎকালীন সামরিক সরকারপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। অযৌক্তিকভাবে বললেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেবেন না।

সহজ অর্থ হলো বাঙালিরা ভোটে জিতলেও বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেবেন না। ক্ষমতার অংশীদার তারাও হবে। ফলে বিক্ষোভের দাবানল জ্বলে উঠল সারা পূর্ব-পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে। নিয়ম ও আইনের মধ্য দিয়েই নির্বাচন হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ বা বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছে।

 

স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল

 

ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার অন্যায় ঘোষণা বাঙালিরা কেউই মেনে নিতে পারল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন ।

এ দেশ পাক সরকারের নির্দেশে চলবে না। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ এখন থেকে শেখ মুজিবের নির্দেশে চলবে। আর এ নিয়ম চলবে যতদিন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা না হয় ।

তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের চিত্রশিল্পীরা সবাই এক জোট হয়ে আলোচনায় বসলেন ছবি এঁকে, পোস্টার ও বড় বড় ব্যানার লিখে বাঙালির এই অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হলো।

১০ দিন ধরে কয়েকশ ছবি ও পোস্টার এঁকে চিত্রশিল্পীরা ১৭ই মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিনে শহিদমিনার থেকে বিপ্লবী চিত্রের মিছিল বের করলেন, যা ছিল বিশাল এক অভিনব মিছিল। প্রত্যেক শিল্পীর হাতে একটি করে আঁকা চিত্র।

আর এসব চিত্রের বিষয় হচ্ছে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের তথা বাঙালিদের বঞ্চনার ছবি, নির্যাতনের ছবি, বাঙালির সম্পদ লুট করে পশ্চিম-পাকিস্তানের উন্নয়নের ছবি, বাংলার ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ ও অবহেলার ছবি, সেইসঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ছবি।

 

স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল

 

এই বিপ্লবী চিত্রের মিছিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্বাধীনতা। এই ৪টি অক্ষর বড় বড় করে সুন্দরভাবে লিখে ৪টি মেয়ের গলায় ঝুলিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে হেঁটে যাওয়া। পাকিস্তানের সামরিক সরকার নানাভাবে ও নানান কৌশলে তখনও আশা দিয়ে যাচ্ছে যে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসে একটা মিমাংসায় যাওয়া যাবে।

কিন্তু বাঙালির প্রিয় নেতা ৭ই মার্চ জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ও এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাই ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। পাকিস্তানের সৈন্যদের সঙ্গে আমাদের অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে।

৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা বিষয়ে ঘোষণার পর পূর্ব-পাকিস্তানের ঘরে-ঘরে সাড়া পড়ে গেল। নানাভাবে ভবিষ্যৎ কর্মসূচির জন্য প্রস্তুতি চলতে লাগল। কিন্তু প্রকাশ্যে জোরেশোরে কেউ কিছু বলতে পারছে না। কারণ, তখনও মার্শাল ল বহাল রয়েছে।

চিত্রশিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা থেকে মূল বিষয়টা বুঝে ফেললেন। তাঁরা অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তাই শিল্পীরা ছবি ও পোস্টারের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই স্বাধীনতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরলেন। মার্শাল ল এর আইন অনুযায়ী এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর জন্য দেখামাত্র গুলি করতে পারে। চিত্রশিল্পীরা মৃত্যু হতে পারে জেনেই এই

মিছিল বের করেছেন। যে চারটি মেয়ে এই চারটি অক্ষর ‘স্বাধীনতা’ বুকে ঝুলিয়ে মিছিলের সামনের দিকে ছিল এদের তিনজন চারুকলার ছাত্রী আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। তাঁর নাম সুলতানা কামাল। বর্তমানে মানবাধিকার নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা।

 

স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল

 

চারুকলার ছাত্রী সাঈদা কামাল ও ফেরদৌসি পিনুর পরিচিতি চিত্রশিল্পী এবং আরেকজন ছাত্রী সামিদা খাতুন ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শহিদ হন। এই বিপ্লবী মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।

সেদিন তিনিই ছিলেন শিল্পীদের সবচেয়ে বড় সাহস ও শক্তি। রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল এই চলমান প্রদর্শনী দেখার জন্যে। অনেকেই ছবি বহন করার জন্য শিল্পীদের পাশাপাশি হেঁটেছেন। খবর পেয়ে বেগম সুফিয়া কামাল মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পাশে থেকে মিছিলের শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

মিছিলটি শহিদমিনার থেকে সেগুন বাগিচার তোপখানা রোড হয়ে বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ হয়ে নবাবপুর রোড ধরে ভিকটোরিয়া পার্ক বা বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত গিয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের সেনাবাহিনী বা পুলিশবাহিনী মিছিলে বাধা দেওয়ার বা গুলি করার সাহস করেনি ।

দলীয় কাজ: অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের শিল্পীদের অবদানের চিত্রগুলো সংগ্রহ করে প্রদর্শন কর।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment