আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নবান্ন ও বাংলা নববর্ষ ,যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা অধ্যায় এর অন্তর্ভুক্ত।
নবান্ন ও বাংলা নববর্ষ
১৯৭০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১০/১২ জন তরুণ চিত্রশিল্পী, কবি ও সাংবাদিকের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন চিত্রপ্রদর্শনী ।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। অগ্রহায়ণ মাসে কৃষক ফসল (ধান) কেটে ঘরে তোলে। সারা বছরের পরিশ্রম শেষে চাষির ঘরে ঘরে আনন্দ। নতুন ধানের পিঠা, পায়েস খাওয়া, আনন্দ অনুষ্ঠান করা, যেমন- কবিগানের লড়াই, হাডুডু, দাড়িয়াবান্দা খেলা, যাত্রাপালার আয়োজন এবং কখনো কখনো মেলা।
গ্রামের সেই নবান্ন উৎসবকে নতুনরূপে শহরে পালন করতে শুরু করে চিত্রশিল্পীরা। ছবি এঁকে বিশাল প্রদর্শনী হলো। শিল্পাচার্য তাঁর বিখ্যাত নবান্ন শীর্ষক নামের দীর্ঘ স্কুল ছবিটি এই নবান্ন প্রদর্শনী উপলক্ষেই আঁকলেন, যার দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট এবং প্রস্থ ৬ ফুট।
নবান্ন প্রদর্শনী জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। শিল্পীরা তারপরই করলেন- বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কালবৈশাখী নামে একটি চিত্রপ্রদর্শনী। বৰ্তমান চারুকলা অনুষদে এই প্রদর্শনীটিও মানুষের মন জয় করেছিল।
শিল্পীরা যেসব ছবি এঁকেছিলেন তার বিষয় ছিল বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, চিন্তা, স্বপ্ন, ষড়ঋতুতে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ ইত্যাদি। সেই প্রদর্শনী থেকেই পরবর্তীকালে কিছুটা পরিবর্তন হয়ে রূপ নেয় বর্তমান পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠান ও মেলা।
বর্তমানে নিয়মিতভাবেই বাংলা নববর্ষ ও নবান্ন উৎসব চারুকলার চত্বরে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ পালন করে যাচ্ছে।
তাই সহজেই বলা যায় চিত্রশিল্পীদের চিন্তা-চেতনা ও শিল্পকর্মের মাধ্যম হিসেবে নববর্ষ উৎসব ও নবান্ন বাংলার মানুষকে নিজের দেশের প্রতি, নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হতে ও গর্ববোধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং চর্চার মাধ্যমে সব সময়ই করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সেই সময়ে নবান্ন চিত্রপ্রদর্শনী ছিল বিশাল ও বিপ্লবী পদক্ষেপ। যাঁরা এই প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন তাঁদের জন্য ছিল অনেক বাধা ও ভয়ভীতি। সেই সময়ের পাকিস্তানি সামরিক সরকার এই ধরনের উদ্যোগকে মনে করত পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী।
অন্যদিকে কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি অপপ্রচার করে বলতে লাগল এই প্রদর্শনীর পেছনে শিল্পাচার্য জয়নুল ও উদ্যোক্তা শিল্পীদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, ইত্যাদি। কিন্তু শিল্পীরা অশেষ চেষ্টায় সব শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে এমন একটি প্রদর্শনী করলেন যা দেখে মানুষ বিস্মিত ও বিমোহিত।
প্রায় হারিয়ে যাওয়া নবান্ন উৎসবের আনন্দকে শহরের মানুষদের নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন শিল্পীরা। প্রায় সব শিল্পীই এঁকেছেন বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার নানারকম চিত্র। অন্য দিকে আছে মহাজনের শোষণ ও নানাভাবে বঞ্চিত হওয়ার ছবি।
বাংলাদেশের নদী-নালা, মাঠ-ঘাট ও বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের ছবি। নবান্ন চিত্রপ্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় অর্জন শিল্পাচার্যের ৬০ ফুট লম্বা ছবি ।
ছবিটি কালো কালিতে জোরালোভাবে তুলিতে ড্রইং করে এঁকেছেন। তারপর সামান্য জলরঙের প্রলেপ দিয়েছেন। ছবি কালো রঙে হলেও আঁকার গুণে মনে হয় রঙিন ছবিই দেখছি।
এত দীর্ঘ আকারের ছবি বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পী করেননি। ছবিটি একটু মোটা কাগজে আঁকা। ভাই গোলাকার ভাঁজ করে রাখতে হয়। শুধু প্রদর্শনীর সময় মেলে ধরতে হয়। ‘নবান্ন’ স্কুল চিত্রটি শিল্পকলা জগতের মূল্যবান সম্পদ।
নবান্ন প্রদর্শনীর প্রধান উদ্যোক্তা ও উপদেষ্টা ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অন্যান্য সদস্যরা হলেন- শিল্পী হাশেম খান, শিল্পী রফিকুন নবী, লেখক ও শিল্পী বুলবন ওসমান, শিল্পী মঞ্জুরুল হক, আবুল বারক আলভী, বীরেন সোম, মতলুব আলী, শিল্পী ও সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক মো. আকতার (আলবদরদের যারা ১৯৭১-এ শহিদ) প্রমুখ।
নবান্ন প্রদর্শনী উপলক্ষে ‘নবান্ন’ নাম দিয়ে দেশের খ্যাতনামা ও নবীন কবিদের কবিতা ও ছড়াসহ একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছিল।
কাজ : নবান্ন ও বাংলা নববর্ষে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে সেসব বিষয় সম্পর্কে পাঁচটি বাক্য লেখ।