আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা ,যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা অধ্যায় এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম-পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বর্ণনা করতে পারব ।
• স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে চারুশিল্পীদের ভূমিকা বর্ণনা করতে পারব ।
• আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে চারু ও কারুশিল্পীদের অবদান ব্যাখ্যা করতে পারব।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় হঠাৎ করে একদিনে শুরু হয়নি। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে।
ব্রিটিশরা দুশো বছর এদেশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ ভারত বা ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি দেশ হয়। মুসলমান-অধ্যুষিত বা ইসলাম ধর্মীয় মানুষদের জন্য পাকিস্তান- আরেকটি ভারত নামেই স্বাধীনতা লাভ করে।
পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান। ভারতবর্ষের মানচিত্র দেখলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে ভারতবর্ষের পশ্চিম কোণে অবস্থিত পশ্চিম-পাকিস্তান এবং প্রায় সর্ব পূর্বে পূর্ব- পাকিস্তান। দুই অঞ্চলের মধ্যে ছিল বিশাল দূরত্ব।
ভারতবিভাগের সেই সময় ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের মূল্যহীনতার চরম বিপর্যয় ঘটেছিল যার নাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে চলে যেতে বাধ্য হলো হিন্দুরা।
অহেতুক হত্যা, নির্যাতন, জ্বালাও পোড়াও করে লক্ষ লক্ষ নিরীহ হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হলো। এই দাঙ্গা ও নিরীহ মানবসন্তান হত্যা ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক কলঙ্কময় ঘটনা।
পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তান একই দেশ হলেও একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনোকিছুতেই দুই দেশের মধ্যে মিল ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। ৯৯ ভাগ মানুষই বাংলায় কথা বলে।
একমাত্র দেশভাগের সময় ও দাঙ্গায় যারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে চলে আসে তারা কথা বলত উর্দু ও হিন্দি ভাষায়। অল্প কয়েকদিনে তারাও বাংলা শিখে ফেলল। পোশাক, খাওয়াদাওয়া, জীবনযাপন, সংস্কৃতি সবকিছুই ভিন্ন। এমনকি জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশও পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে ভিন্ন ।
পশ্চিম-পাকিস্তান আয়তনে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক গুণ বড় হলেও সেখানে লোকসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ। পূর্ব পাকিস্তানে ৫৫ ভাগ। পশ্চিম-পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশে ছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পশতু ও উপজাতীয়দের মিশ্রিত ভাষা। মাত্র ১৫ ভাগ মানুষ কথা বলে উর্দু ভাষায়।
এমন একটি অবস্থায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু।
জোরালো প্রতিবাদ জানাল পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা— শুধু উর্দু হবে কেন? ৫৫ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলাকেও উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করা হোক।
কিন্তু পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের এই ন্যায্য অধিকারের কোনো গুরুত্ব দিল না। বরং অবহেলাই করল। ধীরে ধীরে দেখা গেল স্বাধীন দেশের মানুষদের সমান অধিকার থাকলেও শুধু ভাষার বিষয়েই নয়, সব ক্ষেত্রেই শাসকরা পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের অবহেলা করছে।
চাকরির ভালো ও উচ্চপদগুলো পশ্চিম-পাকিস্তানের মানুষদের দিচ্ছে। বাঙালিরা উপযুক্ত ও গুণী হলেও তাদের বঞ্চিত করে পশ্চিম- পাকিস্তানের অপেক্ষকৃত কম অভিজ্ঞদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসিয়ে বাঙালিদের অপমান করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনীতে বেশিরভাগই পশ্চিম-পাকিস্তানের মানুষকে ঢোকানো হচ্ছে।
কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই পশ্চিম-পাকিস্তানের মানুষদের একরকম জোর করে বসিয়ে দিয়ে তাদের মর্যাদা দিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষদের উপর শোষণ, আধিপত্য বিস্তারের ব্যবস্থা চলতে থাকে।
বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার চেষ্টা করে নানাভাবে। বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত এবং বাঙালির অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
শুধু তা নয়, অনেক সময় শাসকগোষ্ঠীর পেটোয়া বাহিনী এর জন্য অত্যাচার চালায় সাধারণ মানুষদের ওপর। শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার দাবিতে রাজপথে বের হওয়া ছাত্র-জনতার মিছিলে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন— সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ আরো অনেকে।
এভাবে ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৫৮ এবং পুরো ষাটের দশক পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য বার বার প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে।
ফলে অনেক রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিসেবী, ছাত্র-জনতা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকবর্গের দ্বারা বারে বারে নির্যাতিত হয়েছে, মিথ্যা অভিযোগ এনে জেলে পুরেছে, বহু নেতা ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে ও নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। অনেক জনপদ আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু বাঙালিরা শত অত্যাচারেও কখনো পিছিয়ে যায়নি।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এই ২৩ বছর সংগ্রাম চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে ৯ মাস অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে বাঙালিরা পূর্ব-পাকিস্তানকে স্বাধীন করেছে- নতুন দেশের নাম হয়েছে বাংলাদেশ ।
আর এই ধারাবাহিক সংগ্রাম ও শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে যাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছিল— তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালি জাতির পিতা।
কাজ : পূর্ব এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের সংস্কৃতির পার্থক্য দেখিয়ে ৫টি বাক্য লেখ।